"অক্রোধী" (২)

  "আমি অক্রোধী"—দেবদ্যুতি বন্দোপাধ্যায় 

আচার্য্য দেব শ্রীশ্রীদাদাকে দেখে একদিন শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছিলেন, " দাদুর মুখমণ্ডলে রুদ্র ভাব ও বিষ্ণুভাব দু'টোর ই সমাবেশ হয়েছে। " শ্রীশ্রীদাদার বয়স তখন খুব ই কম। আশ্রমের এক বৃদ্ধা মা তাঁকে দেখলেই রসিকতা করে বলতেন, " এই তো আমার বর।" এই কথাটি তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না। বারবার ঐরকম বলতে বারণ করতেন তাঁকে। কিন্তু বৃদ্ধার রসিকতা বড়দাদাকে দেখলেই চাগাড় দিয়ে উঠতো।

একদিন খুব রাগ হলো শ্রীশ্রীদাদার। ঐ বৃদ্ধা যে পথ দিয়ে যাওয়া আসা করতেন, সেই পথে কাঁটা পুঁতে রাখলেন। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে র ইলেন। এবার স্বয়ং আচার্য্য শেখাচ্ছেন, ঐ বয়সেই আমাদের, ক্রোধ এলে কেমন করে দমন করতে হবে তাকে। এগিয়ে এসে বৃদ্ধা ঠিক যখন কাঁটার উপর পা ফেলতে যাবেন, তৎক্ষণাৎ তড়িৎ গতিতে ছুট্টে এসে ঐ বৃদ্ধাকে টেনে সরিয়ে দিলেন। রুদ্র ভাবের জন্যই সাময়িক রেগে গিয়ে কাঁটায় ফেলতে যাচ্ছিলেন ঐ বিরক্তিকর বৃদ্ধাকে। তারপর ই আচরণ করে দেখালেন, আত্মসংযম কাকে বলে! ঠিক এইখানেই তিনি আচার্য্য।

" ধবল অশ্বের মহান বেগে, নিজে চলে চালায় প্রাণী "- এই তো তাঁর অভিজ্ঞান। প্রথমে রুদ্র ভাব, সস্তা " রাগ" নয় কিন্তু। শ্রীরামকৃষ্ণ দেব যাকে বলেছেন, " ফোঁস করা "! তারপর ই জাগ্রত হলো, বিষ্ণুভাব। তাই ঐ বৃদ্ধাকে
সরিয়ে দেওয়া এবং বলে দেওয়া, " কাঁটা আছে, ওদিকে যাবেন না! "

এরপর থেকে ঐ বৃদ্ধা আর তাঁকে কোনও রকম জ্বালাতন করতেন না। দেখানো, শেখানো, আমাদেরকে, আমি ক্রোধের বশবর্তী হবো না। কিন্তু তাই বলে
ক্রোধহীন হয়ে কোনো অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ ও করবো না। ষড়রিপু থাকবে আমার দাস হয়ে।

ব্রাজিলের বিখ্যাত বেস্টসেলার লেখক পাওলো কোয়েলহো- র
একটি জনপ্রিয় গল্পের নাম "30 sec. reading : why do we shout in anger? " তিনি বিশ্বাস করতেন, " প্রত্যেকটি মানুষ ই এক একজন জাদুকর। "

সেই গল্পটি এইরকম :
একদিন একজন শিক্ষক তাঁর ছাত্রদের প্রশ্ন করলেন, " তোমরা
কি বলতে পারো, আমরা যখন অনেক বেশি রেগে যাই, তখন চিৎকার করি কেনো? "
সবাই বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করবার পর, একজন ছাত্র উত্তর দিলো, " কারণ রেগে গেলে আমরা নিজেদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাই, তাই একটা পর্যায়ে চিৎকার করে ফেলি। "

" কিন্তু আমরা যার উপর রাগ করি, সেই মানুষটিও তো আমাদের সামনেই থাকে। তবুও কেনো আমাদেরকে চেঁচিয়ে কথা বলতে হবে তার সঙ্গে? নরম স্বর নিয়ে, আস্তে করে কথা বললেও তো সে শুনতে পাবে, তাই না? "

ছাত্ররা অনেক চিন্তা🙇 করেও শিক্ষক এর এই প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর খুঁজে পেলো না। তখন শিক্ষক ব্যাখ্যা করলেন-
" দুটো মানুষ যখন একে অপরের উপর রেগে যায়, তখন তারা একে অন্যের অন্তর থেকে অনেক দূরে সরে যায়। এই রাগ তাদের অন্তর এর মাঝখানেও দূরত্ব সৃষ্টি করে।

সেই দূরত্ব একটু একটু করে যতো বাড়তে থাকে, ততোই তাদের রাগ বা ক্রোধ বেড়ে যায়। তখন তাদেরকে আরও জোরে চিৎকার করতে হয়। আরও জোরে তর্ক করতে হয়। "

শ্রীশ্রীদাদার ক্ষেত্রে দেখুন, সরে না গিয়ে, ঐ বৃদ্ধাকে বাঁচাবার জন্য অপেক্ষা করছেন!
যে বিরক্ত করে, শত্রুতা করে, তার প্রতিও মায়া, তাকেও ভালোবাসা, এটা তাঁর শিক্ষা।

ক্রোধ আসলে চিৎকার করি আমরা। মাঝেমধ্যে বাংলা
ছেড়ে ইংরেজি! 🚌🚍বাসে ট্রামে , ভিড়ে ঠাসা লোকাল ট্রেনে, লক্ষ্য করবেন, ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত পাবেন।

আবার এর উল্টোটা?
যদি ভেবে দেখি, দু'জন মানুষ যখন একে অন্যের প্রেমে পড়ে, কিম্বা, ভালোবাসে? তখন কি হয়? চিৎকার করি কি?

তখন ভালোবাসার বন্ধনে থাকা
মানুষ দু'জন, একে অন্যের সাথে, ধীরে ধীরে, নরম স্বর এ, গহন আবেগ নিয়ে কথা বলে। কারণ, যারা ভালোবাসে, তারা একে অন্যের অন্তর এর খুব কাছে থাকে।

আর যারা অন্তর এর খুব কাছে থাকে, তাদের কথা শুনতে হলে চিৎকার করার কোনও প্রয়োজন পড়ে না। এমনকি, শুধুমাত্র ফিসফিস করেও তারা তখন কথা বলতে পারে।

বিয়ের বেশ কয়েক বছর পর, ভালোবাসার বন্ধন যখন প্রাত্যহিক অভ্যাসে জীর্ণ দীর্ণ হতে থাকে, তখন ঐ " ফিসফিস"
কেমন করে " হাউহাউ " হয়ে ওঠে, তার অনবদ্য কথন আপনারা সবাই শুনেছেন, পূজনীয় বাবাইদাদার অনবদ্য প্রবচনে!

একদিন তুমি বলতে, আমি শুনতাম। তারপর, আমি বলি, তুমি শুনতে। এখন আমরা দু'জনে মিলে বলাবলি করি, পাড়ার লোকে শোনে!

তাহলে ক্রোধ আসে কখন? যখন ভালোবাসা, দরদ, সহমর্মিতা- এগুলো কমে যেতে থাকে। আবার, মা সন্তানের উপর চেঁচামেচি করলেও অন্তর মহল থেকে তার কল্যাণ ই চান। শুভ চান। মঙ্গল চান। ভেতর থেকে সেই রাগ নয়। সন্তানের ভালোর জন্য একটু রাগ দেখান। যেটা খুব দরকার আছে। নাহলে
সন্তান অমানুষ হবার সমূহ সম্ভাবনা।

এই রাগটা সদর্থক। শত শত উৎস রাগের :
১) আমাকে ওরা অবজ্ঞা করে।
২) ওরা আমার অবাধ্য।
৩) আমার যা চাই, তা পাচ্ছি না।
৪) কেনো আমার কথামতো পৃথিবী চলবে না?
৫) আমার ক্ষতি 😵🤕😢করতে চায় সবাই। ইত্যাদি প্রভৃতি।।
আমি, আমার, আমাকে- আমিত্বে ভরপুর বিশ্বচরাচর মূলতঃ ক্রোধের জনক।
উথাল পাথাল অশান্ত সেই মনকে স্থিতি দিতে , একমাত্র আরোগ্যের নিদান কি?
" সদগুরুর শরণাপন্ন হ ও,
সৎনাম মনন করো,
আর, সৎসঙ্গের আশ্রয় গ্রহণ করো- আমি নিশ্চয় বলছি, তোমাকে আর তোমার উন্নয়নের জন্য ভাবতে হবে না। "
ঠিক ঠিক ভালোবাসা থাকলে ক্রোধ দূরে চলে যায়। খারাপ গুলো খুব বড়ো হয়ে ওঠে না।
এই অনুভবের খুব কাছাকাছি ছিল পাওলোর ভাবনা, গল্প এবং
বিশ্বাস। মন শান্ত হয়ে যায় ঐ
" শান্ত " রসাত্মক গল্পটি পড়লে।
পুনশ্চ : যারা আরও বেশি গভীর ভাবে একে অন্যকে অনুভব করতে পারে, তখন কি হয়, তা'
আমরা জানি। অদ্ভুত সুন্দর ব্যাপার হলো, তখন তাদের ফিসফিস্ করেও কথা বলতে হয় না, তারা দু'জন যখন একে অন্যের দিকে গভীর ভাবে তাকায়, তখনই অন্তর এর অনুভূতি, কথা, শব্দমালা- সব অনুভব করে ফেলতে পারে। কারণ, তখন তাদের অন্তর তাদেরকে " এক " করে ফেলে। তাদের কথা হয় তখন 💜❤️হৃদয়ে হৃদয়ে... ক্রোধ, উষ্মা, ক্ষোভ- এসব তার নাগাল ই পায় না।।

No comments

Powered by Blogger.